শীত এলেই অরণ্যদের গ্রামে আসে লোকটা। এই বাড়ি ওই বাড়ি ঘোরে। উঠোনে বসে কী যেন ভাবে। ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বড়রা তাকে দেখলেই তাড়া করে। ছোটরা পিছু নেয়। সেদিন বড়দের তাড়া খেয়ে লোকটা অরণ্যদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে। হাঁটে আর বলে, ‘হোয়াট আ শেইম, শে-ই-ম, শে-ই-ম-ম!’ পেছনে ছোটা দস্যিরাও গলা উঁচিয়ে বলে, ‘শেইম, শেইম, শেইম-ম-ম!’ আস্তে আস্তে দস্যিদের দল বড় হয়। একজন আঙুলের ইশারায় বলে, ‘ওরে ইংরেজি পাগলা যায় রে; ইংরেজি পাগলা যায়!’
লোকটা কথা বলে না। চুপচাপ হাঁটে। একটু পরপর মাথা চুলকায় আর মাথা থেকে খস করে টেনে চুল তুলে ফুঁ দিয়ে তা বাতাসে উড়িয়ে দেয়। তার অনুকরণ করে পেছনে ছোটা দস্যিরাও। মাথার চুল টেনে তোলার অভিনয় করে। সবাই পারে না। দলের দু-একজনের মাথায় চুলই নেই। তারাও চুল টেনে বাতাসে উড়িয়ে দেওয়ার অভিনয় করে। এই করতে গিয়ে অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। একটু দৌড়ে ফের লোকটার কাছাকাছি যায়। হাঁটায় তাল মেলায়। একসময় তারা গ্রামের শেষ মাথায় চলে যায়। সামনে নদী। লোকটা ঘটঘট করে নদীতে নেমে পড়ে। হাঁটুপানি মাড়িয়ে বুকপানিতে গিয়ে ডুব দেয়। একের পর এক ডুবাতে থাকে। আর বলে, ‘হো-য়া-ট-ট-ট আ হ-টটট!’ ছোটরা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে চোখ বড় করে লোকটার কাণ্ড দেখে। সবার গায়ে গরম জামা; তবু শীতের দাপটে তাদের কাঁপাকাঁপি অবস্থা। অথচ লোকটার গরম লাগে।
কেউ কেউ আঙুলের করে ডুবের হিসাব রাখে। লোকটা বিরতিহীন ডুব দেয়। গুনতে গিয়ে হিসাবে গরমিল হয়ে যায়।
একসময় লোকটা পানি ছেড়ে ওপরে উঠে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ছোটরা বলে, ‘কী করছ ইংরেজি মিয়া?’ লোকটা কথা বলে না। অরণ্য বলে, ‘হোয়াট আর ইউ ডুইং ইংলিশ ম্যান?’ লোকটা সূর্যের দিকে তাকিয়েই জবাব দেয়, ‘আই ইট সানশাইন।’ ছোটরাও তার অনুকরণে সূর্যের দিকে তাকিয়ে হাঁ করে রোদ খেতে চায়। কিন্তু পারে না। লোকটা কিছুক্ষণ সানশাইন খেয়ে ফের গ্রামের পথ ধরে। পেছনে দস্যিরাও। হঠাৎ সে পেছনে ফিরে বলে, ‘মে আই হ্যাভ সাম ফুড?’
দস্যিরা একে অন্যের দিকে তাকায়। কী খাবার দেওয়া যায় লোকটাকে! অরণ্যদের গ্রামে শীতে ভালো সবজি হয়। তাই তারা সবজির কথা ভাবে। বলে, ‘ডু ইউ লাইক ভেজ?’ লোকটা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। সবাই হামলে পড়ে সবজিখেতে। যে যার মতো করে যা পারে, তা এনে লোকটার সামনে হাজির করে। লোকটা বলে, ‘ড্রিংক?’
ছোটরা ভাবে, সাধারণ পানিতে তো এ লোকের চলবে না। কারণ, সে তো এতক্ষণ পানিতেই ছিল। ‘ওকে, ফলো মি।’ বলে অরণ্য হাঁটা ধরে। তার পেছনে সবাই। ছোটদের কারও মুখে কথা নেই। সবাই অবাক হয়ে লোকটার হাঁটা দেখে। একে অন্যকে ঠেলে লোকটার কাছে ঘেঁষতে চেষ্টা করে। মুখ বাড়িয়ে তাকে দেখতে চায়। লোকটা কারও দিকে তাকায় না। থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরে খালি পা আর উদোম গায়ে হাঁটতেই থাকে। সামনে অরণ্য আর পেছনে দস্যি ছেলের দল।
বাড়ির বউ-ঝিয়েরা ছোটদের ডাকতে রাস্তায় চলে আসে। কিন্তু সেদিকে মন নেই দস্যিদের। অরণ্যের পিছু হেঁটে তারা গিয়ে ওঠে পুরোনো একটা জনশূন্য বাড়িতে।
সেই বাড়ির চারপাশ খেজুরগাছে ঘেরা। বিকেলে গাছি এসে তাতে কলসি বসায়। রাতে রস জমে কলসিতে। সকালের দিকে রস পড়া কমে আসে। তাই কলসি খুলে নিয়ে যায় গাছি। তবু জিরিয়ে এক-দু ফোঁটা করে রস পড়ে। ছোটরা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাঁ করে জিব বের করে রাখে। মৌমাছি এসে ভাগ বসায় সেই রসে। অরণ্য একটা খেজুরগাছের নিচে হাঁ করে জিব বের করে লোকটাকে দেখিয়ে বলে, ‘প্লিজ, ট্রাই ইট।’ লোকটাও অরণ্যের মতো গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাঁ করে জিব বের করে রাখে। একসময় তার জিবে টুক করে এক ফোঁটা রস পড়ে। সে গিলে আর বলে, ‘হোয়াট আ নাইস ড্রিংক!’
দস্যি বাহিনী এবার একটা তৃপ্তির নিশ্বাস নেয়। লোকটা এক ফোঁটা রস খেয়েই ‘নাউ আই নিড টু গো’ বলে নদীর দিকে হাঁটা ধরে। ছোটরা এবার আর তার পিছু নেয় না। একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। কেউ কিছু বলে না। লোকটা হাঁটতে থাকে। একসময় হাওয়ায় মিলে যায়!
পরদিন আবারও গ্রামে দেখা যায় লোকটাকে। কারও তাড়া খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটে। ছোটরা আর লোকটার পিছু নেয় না। তারা বড়দের কাছে জানতে পারে, একসময় এই গ্রামেই ছিল তার বাড়ি। বংশটাও ছিল ভালো। কোনো এক শীতে নদীতে গিয়ে আর ফেরেনি তার ছোট্ট মেয়েটা। অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া যায় না। সেদিনই লোকটা বাড়ি ছাড়ে। মেয়ের খোঁজে নদীর পাড় ধরে হাঁটে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে। মাঝখানে কয়েক বছর বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফেরে। তত দিনে নদীভাঙনে পড়ে তার বাড়িটাও হারিয়ে যায়। বাড়ির লোকেরা চলে যায় শহরে। লোকটাকেও সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু শীত এলে সে আর শহরে থাকতে পারে না। মেয়ের খোঁজে গ্রামে আসে। খালি গায়ে বাড়ি বাড়ি হাঁটে। নদীতে ডুব দিয়ে মেয়েকে খোঁজে। খুঁজতেই থাকে!
লোকটা কথা বলে না। চুপচাপ হাঁটে। একটু পরপর মাথা চুলকায় আর মাথা থেকে খস করে টেনে চুল তুলে ফুঁ দিয়ে তা বাতাসে উড়িয়ে দেয়। তার অনুকরণ করে পেছনে ছোটা দস্যিরাও। মাথার চুল টেনে তোলার অভিনয় করে। সবাই পারে না। দলের দু-একজনের মাথায় চুলই নেই। তারাও চুল টেনে বাতাসে উড়িয়ে দেওয়ার অভিনয় করে। এই করতে গিয়ে অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। একটু দৌড়ে ফের লোকটার কাছাকাছি যায়। হাঁটায় তাল মেলায়। একসময় তারা গ্রামের শেষ মাথায় চলে যায়। সামনে নদী। লোকটা ঘটঘট করে নদীতে নেমে পড়ে। হাঁটুপানি মাড়িয়ে বুকপানিতে গিয়ে ডুব দেয়। একের পর এক ডুবাতে থাকে। আর বলে, ‘হো-য়া-ট-ট-ট আ হ-টটট!’ ছোটরা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে চোখ বড় করে লোকটার কাণ্ড দেখে। সবার গায়ে গরম জামা; তবু শীতের দাপটে তাদের কাঁপাকাঁপি অবস্থা। অথচ লোকটার গরম লাগে।
কেউ কেউ আঙুলের করে ডুবের হিসাব রাখে। লোকটা বিরতিহীন ডুব দেয়। গুনতে গিয়ে হিসাবে গরমিল হয়ে যায়।
একসময় লোকটা পানি ছেড়ে ওপরে উঠে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ছোটরা বলে, ‘কী করছ ইংরেজি মিয়া?’ লোকটা কথা বলে না। অরণ্য বলে, ‘হোয়াট আর ইউ ডুইং ইংলিশ ম্যান?’ লোকটা সূর্যের দিকে তাকিয়েই জবাব দেয়, ‘আই ইট সানশাইন।’ ছোটরাও তার অনুকরণে সূর্যের দিকে তাকিয়ে হাঁ করে রোদ খেতে চায়। কিন্তু পারে না। লোকটা কিছুক্ষণ সানশাইন খেয়ে ফের গ্রামের পথ ধরে। পেছনে দস্যিরাও। হঠাৎ সে পেছনে ফিরে বলে, ‘মে আই হ্যাভ সাম ফুড?’
দস্যিরা একে অন্যের দিকে তাকায়। কী খাবার দেওয়া যায় লোকটাকে! অরণ্যদের গ্রামে শীতে ভালো সবজি হয়। তাই তারা সবজির কথা ভাবে। বলে, ‘ডু ইউ লাইক ভেজ?’ লোকটা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। সবাই হামলে পড়ে সবজিখেতে। যে যার মতো করে যা পারে, তা এনে লোকটার সামনে হাজির করে। লোকটা বলে, ‘ড্রিংক?’
ছোটরা ভাবে, সাধারণ পানিতে তো এ লোকের চলবে না। কারণ, সে তো এতক্ষণ পানিতেই ছিল। ‘ওকে, ফলো মি।’ বলে অরণ্য হাঁটা ধরে। তার পেছনে সবাই। ছোটদের কারও মুখে কথা নেই। সবাই অবাক হয়ে লোকটার হাঁটা দেখে। একে অন্যকে ঠেলে লোকটার কাছে ঘেঁষতে চেষ্টা করে। মুখ বাড়িয়ে তাকে দেখতে চায়। লোকটা কারও দিকে তাকায় না। থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরে খালি পা আর উদোম গায়ে হাঁটতেই থাকে। সামনে অরণ্য আর পেছনে দস্যি ছেলের দল।
বাড়ির বউ-ঝিয়েরা ছোটদের ডাকতে রাস্তায় চলে আসে। কিন্তু সেদিকে মন নেই দস্যিদের। অরণ্যের পিছু হেঁটে তারা গিয়ে ওঠে পুরোনো একটা জনশূন্য বাড়িতে।
সেই বাড়ির চারপাশ খেজুরগাছে ঘেরা। বিকেলে গাছি এসে তাতে কলসি বসায়। রাতে রস জমে কলসিতে। সকালের দিকে রস পড়া কমে আসে। তাই কলসি খুলে নিয়ে যায় গাছি। তবু জিরিয়ে এক-দু ফোঁটা করে রস পড়ে। ছোটরা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাঁ করে জিব বের করে রাখে। মৌমাছি এসে ভাগ বসায় সেই রসে। অরণ্য একটা খেজুরগাছের নিচে হাঁ করে জিব বের করে লোকটাকে দেখিয়ে বলে, ‘প্লিজ, ট্রাই ইট।’ লোকটাও অরণ্যের মতো গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হাঁ করে জিব বের করে রাখে। একসময় তার জিবে টুক করে এক ফোঁটা রস পড়ে। সে গিলে আর বলে, ‘হোয়াট আ নাইস ড্রিংক!’
দস্যি বাহিনী এবার একটা তৃপ্তির নিশ্বাস নেয়। লোকটা এক ফোঁটা রস খেয়েই ‘নাউ আই নিড টু গো’ বলে নদীর দিকে হাঁটা ধরে। ছোটরা এবার আর তার পিছু নেয় না। একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। কেউ কিছু বলে না। লোকটা হাঁটতে থাকে। একসময় হাওয়ায় মিলে যায়!
পরদিন আবারও গ্রামে দেখা যায় লোকটাকে। কারও তাড়া খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটে। ছোটরা আর লোকটার পিছু নেয় না। তারা বড়দের কাছে জানতে পারে, একসময় এই গ্রামেই ছিল তার বাড়ি। বংশটাও ছিল ভালো। কোনো এক শীতে নদীতে গিয়ে আর ফেরেনি তার ছোট্ট মেয়েটা। অনেক খুঁজেও তাকে পাওয়া যায় না। সেদিনই লোকটা বাড়ি ছাড়ে। মেয়ের খোঁজে নদীর পাড় ধরে হাঁটে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে। মাঝখানে কয়েক বছর বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফেরে। তত দিনে নদীভাঙনে পড়ে তার বাড়িটাও হারিয়ে যায়। বাড়ির লোকেরা চলে যায় শহরে। লোকটাকেও সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু শীত এলে সে আর শহরে থাকতে পারে না। মেয়ের খোঁজে গ্রামে আসে। খালি গায়ে বাড়ি বাড়ি হাঁটে। নদীতে ডুব দিয়ে মেয়েকে খোঁজে। খুঁজতেই থাকে!
0 comments:
Post a Comment